নবাব সিরাজউদ্দৌলা, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। মাতামহ নবাব আলীবর্দি খাঁ’র স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। যদিও এ বিষয়টা অনেকটা বিতর্কিত, তিনি নিজের মাতামহের বিরুদ্ধেও একসময় অস্ত্র তুলেছিলেন ক্ষমতায় বসার লোভে, তবে আজকে সেসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হিসেবে যেদিন আলীবর্দি খাঁ’র ছোট মেয়ে আমেনার পুত্র মির্জা মোহাম্মদ (সিরাজদ্দৌলা) ক্ষমতায় বসলো সেদিনের একটি কাহিনী জানাতে চাই।
নবাবের প্রথম মসনদ আরহন দিবস। আলীবর্দি খাঁ’র মৃত্যুর পর দীর্ঘ চল্লিশ দিবস শোক পালন করেছে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জনগন। সেদিন তারা মুর্শিদাবাদে জমায়েত হয়েছে নতুন নবাবের মসনদ আরোহণ চাক্ষুস দেখতে। চারিদিকে প্রচুর উত্তেজনা। নবাব এলেন, সবাই সসম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে পড়লো। নবাব সিংহাসনে বসলেন, সবাই নত মস্তিষ্কে কুর্নিশ করে নবাব কে অভিবাদন করলেন।
এবার একের পর এক নবাবের আত্মীয় স্বজন ও উচ্চ পদস্থ ব্যাক্তিরা নবাবকে নজর দিলেন (দেখা দিলেন)। এরপর নবাব দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ কে প্রশ্ন করলেন “এইক্ষণে আমি নবাব হইয়াছি কিনা?”
রাজা রাজবল্লভ সম্মতি জানালে নবাব এবার জিজ্ঞেস করলেন, “তবে আমি এখন হুকুম প্রচার করতে পাড়ি?”
রাজবল্লভ বললেন, “তৎসম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। আপনি যা ইচ্ছা হুকুম প্রচার করিতে পারেন”।
নবাব বললেন, “তবে আমার সম্মুখে আমার আতালিক (শিক্ষক) কুলী খাঁ কে হাজির কর”।
এই আদেশ শুনে কুলী খাঁ তো একেবারে আসমানে ভাসতে শুরু করলো। তাঁর ছাত্র এখনো তাকে মনে রেখেছে। এবারে বুঝি দৈন দশা কাটলো। কুলী খাঁ এগিয়ে চললেন নবাবের সিংহাসনের দিকে ছাতি পাঁচ ছয় ইঞ্চি চওরা করে। সবাই সসম্মানে তাকে পথ করে দিলো, নবাবের শিক্ষক বলে কথা। নবাবের সামনে পৌঁছে কুলী খাঁ নবাব কে সেলাম করে নবাবের সামনে দাঁড়ালো।
নবাব চোখ লাল করে বসেছিলেন। কুলী খাঁ মাথা তুলতেই চিৎকার করে বললেন, “কেও হারামজাদা। তাব তুঝে ইয়াদ নেহি থা কি হাম একরোজ ইয়ে তাক্তপার বৈঠেঙ্গে?” (কিরে হারামজাদা। তখন তোর মনে ছিলনা যে আমি একদিন এই আসনে বসবো?)
উপস্থিত সবাই অবাক। কেউ কিছু না বুঝলেও বুঝে নিয়েছে কুলী খাঁ। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত যে নেমে যাচ্ছে বুঝতে পারছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ভয় জমা হতে শুরু করলো। সিরাজ কে যখন পড়াতেন সব শিক্ষক যেমন ছাত্রদের বেত্রাঘাত করতো তিনিও তেমন মাঝেমাঝে সিরাজকে বেত্রাঘাত করতেন। তখন তিনি বোঝেননি যে তিনি ব্যাঘ্রশাবক নিয়ে খেলা করছেন। যে বালক নবাবের দৌহিত্র ও নবাব হবার দাবীদার তাকে তিনি সাধারন ছাত্রের মতোই মাঝে মাঝে বেত্রাঘাত করেছেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু এখন কি হবে? কুলী খাঁ টের পাচ্ছে যে তাঁর হাঁটু কাপছে।
এবার নবাব জল্লাদ কে ডাক দিলেন। অবাক হয়ে গেলো উপস্থিত সবাই। কি হচ্ছে কিছুই কেও বুঝতে পারছে না। জল্লাদ এলো, নবাব উচ্চস্বরে বলিলেন, “ইস বজ্জাৎ কো কাতল কারো”।
থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করলেন এবার কুলী খাঁ। অবস্থা বেগতিক দেখে মীরজাফর, রাজা রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ এসে সিংহাসনের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে নবাবকে কে বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কোন লাভ হল না। নবাব বরং তাদেরকে প্রশ্ন করলেন তারা যে এখন তাকে বোঝাতে এসেছে কিন্তু যখন কুলী খাঁ তাকে বেত্রাঘাত করেছিল তখন তাকে ঠেকায় নি কেন? তিনি বলেন, “পৃথিবীর ধর্মই এই যে যাহার যখন যে এক্তিয়ার থাকে তখন তাহা সে যথাশক্তি নির্দয়ভাবে পরিচালনা করে। কুলী খাঁ যখন আমাকে তাঁর এক্তিয়ারে পেয়েছিল তখন সে আমাকে ছাড়ে নাই। এখন আমি তাহাকে আমার এক্তিয়ারে পেয়েছি, আমি তাহাকে ছাড়িব কেন? কখনোই ছাড়িব না”।
কিন্তু এরপর ও মীরজাফর, রাজা রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ যখন অনুরোধ করতে থাকলো তখন ক্ষেপে গিয়ে নবাব তাদের বললেন, “এখানে নবাব কে? আমি না তোমরা? যদি আমি হই, তাহা হইলে তোমরা চলিয়া যাও। নচেৎ তোমাদের মঙ্গল হইবে না”। আর কিছু বলার থাকে না। তারা উঠিয়া গেলেন অপ্রতিভ হয়ে।
জল্লাদ তখনো ইতস্থতঃ করছে। জল্লাদ হলেও তো সে একজন মানুষ। সে অপেক্ষা করছে যদি নবাব হুকুম পরিবর্তন করেন। নবাব ক্ষিপ্ত হয়ে জল্লাদ কে বললেন তুমি যদি কতল না করো তাহলে আমি করবো, সাথে তোমার কল্লা ও কেটে ফেলবো। জল্লাদের আর কি বা করার আছে। সে কুলী খাঁ কে কতল করতে নিয়ে যেতে গেলে নবাব তাঁর সামনে মঞ্চেই কতল কার্য সমাধা করতে বলেন।
জল্লাদ হুকুম পালন করলো। কুলী খাঁ’র ছিন্ন মস্তক মাটিতে গড়াতে গড়াতে কিসে যেন বেধে গেল। তাঁর দুই চোখ তখনো খোলা। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো অপলক। দেহটা কয়েকবার ঝাঁপটা মেড়ে স্থির হয়ে গেল আজন্মের মতো।
এরপর কুলী খাঁ’র ছিন্ন মস্তক ও দেহ একটা বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে হাতির পিঠে চাপিয়ে সারা শহর ঘোরানো হয় প্রথা অনুযায়ী। কথিত আছে যে, মুর্শিদাবাদের বাজারে এসে এক সময় হাতি দাঁড়িয়ে যায়। মাহুত (হাতির চালক) দেখেন যে বস্তা চুইয়ে মাটিতে কুলী খাঁ’র রক্ত পরছে। হাতি তাঁর ঘ্রান নিচ্ছে। অনেক কষ্টে চেষ্টার পর হাতি আবার চলতে শুরু করে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মীর জাফরের ছেলে মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদিবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে,সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ ও সেই একি হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। কেও কেও বলেন হাতি টা নাকি ঠিক একি জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পরেছিল। কুলী খাঁ’র রক্ত যেখানে পড়েছিলো সেখানেই নাকি নবাবের রক্ত ও পরেছিল চুইয়ে চুইয়ে।
সুত্রঃ “সেকালের দারোগার কাহিনী”- গিরিশচন্দ্র বসু।