বেহুলা- ভালোবাসার যুদ্ধে অদম্য সেনানী।

ভালোবাসা তোমার ঘরে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসুক
ইচ্ছেগুলো তোমার ইচ্ছেগুলো জ্যান্ত হয়ে বুকের ভেতর তুমুল নাচুক
ভালোবাসা তোমার ঘরে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসুক।।

গান টি তানিম নুর পরিচালিত চলচ্চিত্র “ফিরে এসো বেহুলা” এর। অনেকেই হয়তো এরি মাঝে দেখে ফেলেছেন এই ভালো মানের চলচ্চিত্রটি। না দেখে থাকলে দেখে নিতে পারেন। যদি ও আমি আসলে এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি না। আমি আলোচনা করবো বেহুলা কে নিয়ে। শিরোনামেই দেখেছেন আমি বেহুলা কে ভালোবাসার যুদ্ধে অদম্য সেনানী হিসেবে উল্লেখ করেছি। এখন কেন বলেছি তার কারন ব্যাখ্যা করতে চাই।

বেহুলা একটি মিথিকাল ক্যারেক্টার। আর মিথ এর প্রতি আমার দারুন আগ্রহ। যখন মহাস্থানগড় দেখতে গিয়েছিলাম তখন শুনলাম যে ওখানে বেহুলা-লখিন্দরের বাসর ঘর আছে। না দেখে তো আসা যায় না। তখনো আমি এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না। স্থানীয় একজন এর কাছে শুনলাম বেহুলা- লখিন্দরের মিথ। ছোটো ছোট বই ও বিক্রি হয় ওখানে যাতে আপনি বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী পাবেন। আমিও কিনেছিলাম। ফিরে এসে বেশ ঘাটাঘাটি করি। জানতে পাড়ি এই বেহুলার কাহিনী উঠে এসেছে মনসামঙ্গল কাব্য থেকে। মনসা- মঙ্গল কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য নিদর্শন। হরিদাস, বিজয়গুপ্ত, নারায়ন দাস, কেতকা দাস ও খেমনান্দ নামক কবিরা মনসা- মঙ্গল কাব্য রচনা করেন। এখানে ফুটে উঠেছে বেহুলা-লখিন্দরের অসাধারণ কাহিনী। তাহলে আসুন একটু জেনে নেই।

মনসা ছিলেন নারী গর্ভে জন্ম না নেওয়া শিব এর সন্তান। মর্তে বাসুকির কাছে পালিত হয় মনসা। বড় হয়ে জানতে পেরে মনসা শিব এর কাছে যায় এবং কৈলাস এ শিব এর বাড়িতে থাকতে চায়। কিন্তু শিব তার স্ত্রী পার্বতীর ভয়ে মনসা কে মন্দিরে ফুল এর ডালিতে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু পার্বতী মনসাকে দেখে ফেলে এবং মনসা কে তার সতীন মনে করে আঘাত করে তার চোখ নষ্ট করে দেয়। এদিকে রাগান্নিত হয়ে মনসা পার্বতী কে দংশন করে। কিন্তু শিব এর অনুরোধে পার্বতী কে আবার বাচিয়েও তোলে। পার্বতীর ইচ্ছায় মনসা কে বনবাস দেওয়া হয়। বনবাসে ব্রম্মা এর বীর্য ধারন করে মনসা নাগ এর জন্ম দেয়। এসময় সে সর্পদেবী হিসেবে বনবাস থেকে ফিরে আসে।

বনবাস ফেরৎ মনসা নিজের পুজা চালু করার জন্য পিতা শিব এর কাছে অনুরোধ করে। শিব মনসা কে বলে যদি সে চাঁদ সওদাগার কে রাজি করাতে পারে তাহলে পৃথিবীতে তার পুজা চালু হবে। কিন্তু শিব ও দুর্গা ভক্ত চাঁদ সওদাগার কিছুতেই মনসার পুজা করতে রাজি তো হলেন না বরং তাড়িয়ে দেন মনসা কে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে মনসা। চম্পকনগরে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। সাপের কামরে মাড়া যায় চাঁদ সওদাগারের ছয় ছেলে। ডুবে যায় চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরী। সর্বস্বান্ত হয়ে যায় চাঁদ সওদাগর। তারপর ও রাজি হয় না মনসার পুজা দিতে।

এরপর চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর ও তার ব্যবসায়ীক সতীর্থ সাহার কন্যা বেহুলার জন্ম হয় সমসাময়ীক কালে। দুটি শিশুই একসাথে বেড়ে ওঠে এবং একে অপরের জন্য সম্পুর্ণ উপযুক্ত বলে গণ্য হয়। কিন্তু জ্যোতিষী বলেন বেহুলার সাথে লখিন্দরের বিয়ে হলে বাসর ঘরে সাপের দংশনে লখিন্দরের মৃত্যু হবে। চাঁদ তবু ও বেহুলা-লখিন্দরের বিয়ে দেন এবং তাদের জন্য সুরক্ষিত একটি বাসর ঘর বানান কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। কোনও এক ফাক দিয়ে সাপ ঢুকে পরে এবং লখিন্দর কে দংশন করে। এবার ভেঙ্গে পরেন চাঁদ সওদাগর। কিন্তু তবু রাজি হয় না মনসার পুজা দিতে।

তৎকালীন সময়ের নিয়ম অনুসারে সাপে দংশন করা লাশ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হত যদি কোনভাবে ফিরে আসে সেই আশায়। সেভাবেই ভাসিয়ে দেওয়া হল লখিন্দরের লাশ। কিন্তু স্বামী শোকে অন্ধ বেহুলাও ভেলায় ভেসে পরে। ভাসতে থাকে তারা ছয় মাস ধরে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকে কেবলই ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

বগুড়ায় অবস্থিত বেহুলার বাসর ঘর।

একসময় ভেলাটি মনসার পালক মাতা নিতার কাছে আসে। তিনি নদীতীরে ধোপার কাজ করার সময় ভেলাটি ভূমি স্পর্শ করে। তিনি মনসার কাছে বেহুলার নিরবচ্ছিন্ন প্রার্থনা দেখে বেহুলাকে তার কাছে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে চোখের পলকে বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে পৌছে দেন। স্বর্গে বেহুলা নেচে- গেয়ে দেবতাদের খুশি করেন। দেবতারা মনসা কে অনুরোধ করেন লখিন্দর কে বাচিয়ে তোলার জন্য। মনসা তখন বেহুলা কে শর্ত দেন সে যদি চাঁদ সওদাগার কে মনসার পুঁজা দিতে রাজি করাতে পারে তাহলে লখিন্দর কে বাচিয়ে তুলবে। বেহুলা কথা দেয় সে চাঁদ সওদাগার কে রাজি করাবে। খুশি হয়ে মনসা তখন লখিন্দর এবং চাঁদ সওদাগর এর বাকি ছয় ছেলে কে বাচিয়ে তোলে ও চাঁদ এর সকল সম্পত্তি ফেরত দেয়। বেহুলা এসব নিয়ে নিতার সাথে মর্তে ফিরে আসে।

সব ফিরে পেয়ে চাঁদ খুশি হয়ে ওঠে এবং বেহুলার অনুরোধে সে মনসার পুজা দিতে রাজি হয়। তবে সব সত্ত্বেও চাঁদ ভুলে যায়নি দেবী মনসা তাকে কি পরিমান কষ্ট দিয়েছে। তাই তিনি মনসার দিকে না তাকিয়ে বাম হাতে ফুল ছুড়ে দেন। সেই থেকে মর্তে শুরু হয় দেবী মনসার পুজা।

এই ছিল বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনী। তো দেখতেই পাচ্ছেন কতটা কষ্ট করে বেহুলা তার প্রিয় স্বামী কে মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এ জন্যই আমি বেহুলা কে ভালোবাসার যুদ্ধে অদম্য সেনানী হিসেবে অবিহিত করেছি। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে বাচিয়ে তোলার এমন অদম্য চেষ্টার নিদর্শন আর কয়টা পাবেন?

তথ্যসূত্রঃ

১. উইকিপিডিয়া
২. মনসা মঙ্গল কাব্য।