পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ চাণক্য সেনের “পুত্র পিতাকে”।

পিতা-পুত্র সম্পর্ক আমাদের এই উপমহাদেশে ঠিক প্রানবন্ত ছিল না কখনোই, অনেকটা পলি বহন করে চলা নদীর ঘোলা জলের মতো, অনেক সম্পদশালী কিন্তু অসচ্ছ। সেদিক থেকে মা-পুত্র সম্পর্ক অনেক এগিয়ে। তবে আমাদের পিতাদের জেনারেশন বা আমাদের জেনারেশনের পিতারা অনেকটা লিবারেল। তারা শিখেছে বন্ধু হয়ে উঠতে। কিন্তু সেই আবহমান কালের চাপিয়ে দেবার অভ্যাসটা বুঝি জীনগত হয়ে পড়েছে, এতো সহজে যাবে না।

আদিওপাস কমপ্লেক্স এর মতে পুত্ররা শিশু বয়সে তাদের পিতাকে প্রতিদন্ধী মনে করে।এ দন্ধ শুরু হয় মায়ের প্রতি ভালবাসা থেকে। মায়ের ভাগ কাউকে দিতে পুত্র চায় না, এমনকি পিতাকেও না। যেমনটা চানক্য সেনের উপন্যাস “পুত্র-পিতাকে” এর প্রোটাগনিস্ট চরিত্র কেতুর বেলায় ও আমরা দেখতে পাই। মায়ের ভাগ তার শিশু মন পিতাকে দিতে চায় না।

চানক্য সেনের(মূল নাম ভবানী সেনগুপ্ত) “পুত্র-পিতাকে” উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে কেতুকে নিয়ে। যুগের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা অধ্যাপক পিতার পুত্র কেতু। কেতুর পিতা তার পিতা থেকে যা পায়নি দিতে চেয়েছে নিজের পুত্রকে। বন্ধুত্ব, স্বাধীনতা কেতু পেয়েছে তার পিতার কাছ থেকে ছোট্ট বেলা থেকে। সেই বন্ধুত্ব এতোই গভীর পড়তে পড়তে ঈর্ষা জন্মে যায় মনের কোন এক গহীন কোনে।

তারপরও পিতার সাথে জীবন যুদ্ধে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ে কেতু। বোহেমিয়ান মেয়ে সুজান ফোর্ড কেতুর জীবনে এসে সব ওলট পালট করে দেয়। সুজান কে ঠিক মেনে নিতে পারেনা কেতুর পিতা। সুজানের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই কেতুর পিতা অপছন্দ করে বসে। অথচ পিতাই একদিন বলেছিল যে ধর্মের, যে বর্ণের মেয়েকেই কেতু বিয়ে করুক না কেন, তার আপত্তি থাকবে না। কিন্তু সুজানের বেয়াড়া জীবন তাকে বাধা দিতে বাধ্য করে। ফলে পিতা-পুত্র সম্পর্কে চিড় ধরে। সুজানের হাত ধরে বেড়িয়ে পড়ে কেতু।

এরপর বিশ্বের সাথে যেন তালগোল পাকিয়ে মিশে যায় কেতু। তৎকালীন অ্যামেরিকায় (অ্যামেরিকা তখন ভিয়েতনাম যুদ্ধ করছে) তখন কালোরা আন্দোলন করছে সমঅধিকারের দাবিতে। কেতু কাছ থেকে দেখেছে সেই আন্দোলন। আবার ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন তখন যুব সমাজে প্রবল। সেখানটাও তার পদধূলি পাচ্ছে। সুজান অনেকটা প্রতিক্রিয়াশীল মেয়ে, বিশ্বের যে প্রান্তে মানবিকতা সম্রাজ্যবাদীদের কাছে পদদলিত হচ্ছে সুজান তাদের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুজানের সাথে কি সুখী হতে পারবে কেতু? সেটা যদি বলেই দেই তবে আপনি বইটা কেন পড়বেন?

নিজের চব্বিশতম জন্মদিন উপলক্ষে পিতাকে চিঠি লিখেছে কেতু। অনেকটা কনফেসের মতো চিঠিটা। কিছু না চেপে রেখে লিখে গিয়েছে তার জীবন সম্পর্কে, জীবনবোধ সম্পর্কে। যেন একটা বিশাল ক্যানভাসে নিজের মনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে কেতু দারুন দক্ষতায়। এই চিঠিটাই উপন্যাস। পিতাকে ভালবাসা, পিতার থেকে দূরে সরে আসা, বিচ্ছিন্নতার ব্যাকুলতা, পুনরায় ফিরে আসার চেষ্টার দারুন একটা মহাকাব্য যেন এই উপন্যাস।

বইঃ পুত্র-পিতাকে
লেখকঃ চানক্য সেন
প্রকাশনীঃ প্রকাশ ভবন (কোলকাতা)
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৫৮
পৃষ্ঠাঃ ৩৪২

বি.দ্রঃ ইবুক পাবেন এখানে