সেই ছোট ছোট পা ফেলে গুটগুট করে বুক ভর্তি একরাশ ভয় নিয়ে প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিলাম খুব করে কেঁদেছিলাম। এতগুলো অজানা অচেনা ছেলে মেয়ের মাঝে নিজেকে কেন যেন খুব অসহায় লাগছিল। সেই অজানা অচেনা ছেলে মেয়ে গুলোই হয়তো আমার জীবনের সবচাইতে ভালো বন্ধু হতে পারতো। কিন্তু হয় নি। কারন বন্ধুত্ব ঠিক করে বুঝে ওঠার আগেই বাবার ট্র্যান্সফার।
নতুন জায়গা নতুন স্কুল। আবারও সেই একি ভয়। কারন তখনো আমি সেই ছোটটিই আছি। এবার ও যখন মা ক্লাসে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ফুঁপিয়ে খুব কেঁদেছি। কারন আবারও সেই অনেক গুলো ছেলে মেয়ের মধ্যে আমাকে একা রেখে চলে গেছে মা। এই ছেলে মেয়ে গুলোও হয়তো আমার খুব ভালো বন্ধু হতে পারতো। কিন্তু হয় নি। কারন ঐদিনই আমার ওই স্কুলে শেষ দিন ছিল। তারপর আর আমাকে মেরেও ওই স্কুলে পাঠাতে পারেনি মা। পারেনি বাবার আদর ও। কারন তেমন কিছু না। ক্লাস টিচার আমাকে বলেছিল ” এই তোর নাম কি”? ঐটুকুন আমার আত্মসম্মানবোধে চরম আঘাত হেনেছিল ওই “তোর” শব্দটি। ছেঁড়ে দিলাম স্কুল। ওই ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোর বন্ধু হয়ে ওঠা আর হল না।
আবার নতুন স্কুল। আবার নতুন নতুন ছেলে মেয়ে। এবার ভয় টা একটু কমে গেছে। আফ্রিকান আদিবাসীদের যুদ্ধের দামামা থেমে গেছে, দুরু দুরু বুক এখন আমার। যাই হোক এখানে এসে আমি প্রথম বন্ধুত্তের স্বাদ পেলাম। বুঝতে পারলাম এই জিনিস টা একেবারে খারাপ না। বেশ কিছু বন্ধু হল, যার কিছু হারিয়ে ফেলেছি কালের ঘূর্ণনে। কিছু এখনো জরিয়ে রেখেছে অক্টোপাসের মতো।
এই তাই করতে করতে বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। ওই ছোট্ট আমাকে নিতে হল যুদ্ধের প্রস্তুতি। কারন ততদিনে আমি ওই কিশালয়, বেবি, কেজি নামক শ্রেণী গুলো টপকে ফেলেছি। এখন জিলা স্কুল এ ভর্তি হতে হবে। সে কি কসরত। আমাকে পড়াতে পড়াতে মা এর নাভিশ্বাস। এবং অবশেষে যুদ্ধজয়। ছিনিয়ে আনলাম একটা বেঞ্চে বসার অধিকার, যা সিংহাসন এর চাইতে কোনও অংশে কম না। এবং সাথে সাথে কিছু নক্ষত্রের পতন। যাহারা বিজয়ি হতে পারে নি, তাদের কে ধিরে ধিরে ভুলে গেলাম। পরাজিতদের মনে রাখে না কেও। আমি ও রাখিনি। এটাই ভয়ংকর বাস্তব।
নতুন স্কুল কিন্তু একটু ও ভয় নেই। কারন সাথে আছে কিছু পরিচিত বন্ধু। কিছু ধিরে ধিরে অনেকে দূরে সরে গেলো, আবার অনেক নতুন বন্ধু হলো। এভাবেই চলতে থাকলো দিন। কখনও মারামারি, কখনও আড়ি, মন কষাকষি তারপর আবার হাসাহাসি। টিফিন ভাগ করে খাওয়া, ক্লাসে পাশের জন কে কলমের খোঁচা মেরে কিছুই জানিনা এমন ভাব করে বসে থাকা কি না করেছি। এভাবে আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলাম আর বন্ধুর সংখ্যা যোজন বিয়োজন হতে থাকলো সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। এভাবেই একদিন দিয়ে দিলাম সেই মহা মূল্যবান কাগজটি অর্জনের পরীক্ষা। এবং বেচে বর্তে নিয়েও নিলাম নিজের করে।
ভর্তি হলাম কলেজে। আবার এলো নতুন বন্ধুর জোয়ার। সাথে ভাটার টানে হারিয়েও গেলো কিছু বন্ধু। কিন্তু এখনো যেগুলান টিকে আছে সেগুলো মনে হয় কখনোই ছাড়বে না। জালিয়েই মারবে। এই সময়টা যেন কীভাবে কেটে গেলো। খুব তারাতারি যেন পাট চুকিয়ে ফেলতে হল কলেজ জীবনের। তবে এই সময়ের মধ্যেই স্মৃতির অ্যালবাম ভরে ফেললাম অসংখ্য ভালো লাগার ছবি দিয়ে।
এর আগে করেছি শহর জয়। এবার করতে হবে দেশ জয়। তাই চাপ টা ও একটু বেশি। কীভাবে কীভাবে যেন এবার ও জয় করে ফেললাম। চান্স পেয়ে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ যেন সোনার হরিন হাতে পেয়ে গেলাম। এখানে এসে শিখলাম বাস্তবতা। প্রচুর মানুষের সাথে মিশলাম। ব্যাগ ভরে ফেললাম গাদাগাদা অভিজ্ঞতা দিয়ে। পেলাম কিছু খুব ভালো বন্ধু, কিছু মুখোশ পড়া বন্ধু। তবে জীবনের এই সময়কালটুকু কখনোই ভোলার নয়।
আজ বন্ধু দিবস। আজ আমি আমার প্রতিটা বন্ধু কে স্মরন করতে চাই। একদিনের জন্য ও যে বন্ধু ছিলি তাকেও আজ বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা জানতে চাই। অনেকের মুখই মনে করতে পারছি না। কিন্তু মনের একেবারে গভীর কোন থেকে প্রত্যেকটি বন্ধুকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। তোরা ছিলি বলে জীবনটা আজ এত সুন্দর। তোরা আছিস বলে এখনো ভালো আছি। ভালো থাকিস সবাই। খুব ভালো থাকিস।