একলব্য, মহাভারতের এক অবহেলিত চরিত্র। পাণ্ডব পুত্র অর্জুনের ঈর্ষা আর পান্ডব ও কৌরবদের অস্ত্র শিক্ষা গুরু দ্রোণাচার্য এর অধিক অর্জুন প্রীতি একলব্য কে বেধে রেখেছিল অবহেলার কারাগারে। সেই একলব্য কে তুলে এনেছেন সুলেখক হরিশঙ্কর জলদাস তার এপিকধর্মী উপন্যাস “একলব্য” তে।
নিষাদরাজা হিরন্যধনু ও রানি বিশাখার একমাত্র পুত্র একলব্য। শৈশব থেকেই একলব্য এর ইচ্ছে সে ভারতের সেরা অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য এর কাছ থেকে অস্ত্র শিক্ষা নেবে। উপন্যাসের শুরু হয় যখন একলব্য তার পিতা হিরন্যধনুকে তার অভিপ্রায় ব্যাক্ত করে। কিন্তু বিচক্ষণ হিরন্যধনু চায় না তার পুত্র হস্তিনাপুরে যাক ব্রাম্মন দ্রোণাচার্য এর কাছ থেকে অস্ত্র শিক্ষার জন্য। কেননা তিনি জানতেন ব্রাম্মন দ্রোণাচার্য কখনই একজন ব্যাধ পুত্রকে অস্ত্র শিক্ষা দিবেন না। কিন্তু একলব্য নাছোড়, সে যাবেই। একপর্যায়ে হিরন্যধনু তার পিতা অনোমদর্শী কে অবহিত করলে, অনোমদর্শী পরামর্শ দেয় একলব্য কে যাওয়ার অনুমুতি দিতে।
মহাআনন্দে একলব্য রওনা দেয় দূরবর্তী হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে। বহু পথ পাড়ি দিয়ে একলব্য হাজির হয় দ্রোণাচার্য এর সামনে। কিন্তু দ্রোণাচার্য যে ব্রাহ্মণ, নিম্ন বর্ণের কাউকে অস্ত্র শিক্ষা দেবে না।ব্যাধ রাজার (ব্যাধ বলতে বুঝায় যারা শিকারি বা মৃগয়াজীবী জাতি তাদের কে) ছেলে হওয়ায় একলব্য কে তিনি অপমান করে তাড়িয়ে দেন।
মনের দুঃখে একলব্য আর বাড়ি ফিরে না গিয়ে বনের মধ্যে একটা ছোট্ট কুটির বানিয়ে থাকতে শুরু করে। দ্রোণাচার্য যতই অপমান করুক তাকে যে সমস্ত মন দিয়ে একলব্য তার শিক্ষাগুরু হিসেবে ভেবে এসেছে। তখন একলব্য তার কুটির এর সামনে গুরু দ্রোণাচার্য এর একটি মৃন্ময় (মাটি নির্মিত) মূর্তি তৈরি করে সেই মূর্তি কে নিজের গুরু হিসেবে মান্য করে নিজে নিজেই অস্ত্র সাধনা করা শুরু করে। এভাবে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। এরমধ্যে হস্তিনাপুরে দ্রোণাচার্য এর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে মহাবীর হয়ে ওঠে অর্জুন। কৌরবদের একশ ভাই, পাণ্ডবদের অর্জুন বাদে বাকি চার ভাই, কর্ণ, এমনকি দ্রোণাচার্য এর নিজের ছেলে অশ্বত্থামার থেকেও প্রিয় হয়ে ওঠে অর্জুন দ্রোণাচার্য এর কাছে। দ্রোণাচার্য তার সেরা অস্ত্র “ব্রমাস্ত্র” তুলে দেন অর্জুনের হাতে।
এদিকে অরন্য মাঝে একলব্য তার একাগ্র সাধনার মাধ্যমে নিজে নিজেই শিখেছে অস্ত্র চালনা। এমন কিছু ট্রিক সে আবিস্কার করে ফেলেছে যা দুনিয়ার আর কেউ জানে না। একবার মৃগয়ায় (পশু শিকার) গিয়ে অর্জুন দ্যাখে ব্যাধ পুত্র একলব্য এমন কিছু পারে যা সে পারেনা। অর্জুন একলব্য এর কাছে জানতে চায় কে তাকে এসব শিখিয়েছে? একলব্য বলে সে এসব দ্রোণাচার্য এর কাছে শিখেছে। কারণ একলব্য তো দ্রোণাচার্য এর মৃন্ময় মূর্তিকে তার গুরু ধরে নিয়ে এতকাল সাধনা করে আসছে। একথা শুনে ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে অর্জুন। সে ছুটে যায় দ্রোণাচার্য এর কাছে। দ্রোণাচার্য তো শুনে অবাক। সে তো নিষাদ রাজার ছেলেকে কোন শিক্ষা দেয়নি, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এদিকে অর্জুন ও নাছোড়, ব্যাবস্থা একটা নিতেই হবে। দ্রোণাচার্য যে কথা দিয়েছিল অর্জুন কে যে তার থেকে বড় ধনুর্ধর আর কেউ হতে পারবে না।
অর্জুন কে নিয়ে দ্রোণাচার্য ছুটলেন একলব্য এর কুটিরে। সেখানে গিয়ে তো দ্রোণাচার্যর চক্ষু চড়কগাছ। তার মৃন্ময় মূর্তিকে গুরু মেনে এক ব্যাধ পুত্র যে সেরা হয়ে উঠেছে। খুশিতে কোথায় একলব্য কে বুকে জরিয়ে ধরবে তা না করে উলটো অর্জুনের কূট বুদ্ধিতে দ্রোণাচার্য একলব্য এর কাছে গুরুদক্ষিনা চেয়ে বসলো। কি সেই গুরু দক্ষিনা? একলব্য কে তার দক্ষিন হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিতে হবে। একজন তীরন্দাজের জন্য সবথেকে জরুরী যেই অঙ্গ সেটাই দাবী করে বসলেন দ্রোণ। কিন্তু একলব্য একবার ও নিজের কথা না ভেবে নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে রেখে দিলেন গুরু দ্রোণাচার্য এর পায়ের কাছে। তৎক্ষণাৎ ঘুরে চলে গেলেন দ্রোণ আর অর্জুন। একবার ফিরেও তাকালেন না একলব্য এর দিকে।
এরপর কি হল? কিভাবে আবার একলব্য নিজেকে গড়ে তুললেন একটু একটু করে? কুরুক্ষেত্রের সেই বিশাল যুদ্ধে কি সে পেরেছিল অর্জুন বধ করতে? কেন একলব্য আক্রমন করে বসলেন কৃষ্ণের রাজধানীতে জানতে হলে বইটি পড়তে হবে।
লেখক দারুন সাবলীল ভাবে লিখে গেছেন। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে বইটা কি একলব্য কে নিয়ে লেখা হচ্ছে নাকি দ্রোণাচার্য কে নিয়ে। কারন একটা দীর্ঘ সময় জুরে লেখক দ্রোণাচার্য কে নিয়েই লিখেছেন। পৃষ্ঠার হিসেব করতে বসলে তো আমার মনে হয় দ্রোণাচার্য কে নিয়েই বেশি লিখেছেন লেখক। তবে মহাভারত এর কাহিনী নিয়ে যাদের আগ্রহ আছে তাদের অবশ্যই এই বইটা পড়ে দেখা উচিৎ। তবে এই বই পড়ার জন্য অবশ্যই মহাভারত পড়া থাকা জরুরী। যদিও লেখক অনেক দারুন ভাবে ডিটেইল এ বর্ণনা করেছেন, তারপরও মহাভরত পড়া না থাকলে আসল রস আস্বাদন করা যাবে না।
বইঃ একলব্য
লেখকঃ হরিশঙ্কর জলদাস
প্রকাশনীঃ অন্যপ্রকাশ।