আফ্রিকায় সব্যসাচী।

সব্যসাচী চক্রবর্তী, ফেলুদা যেন তাকে চিন্তা করেই লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়, ওপার বাংলার অন্যতম শক্তিশালী অভিনেতা। কিন্তু তিনি যে দারুন একজন ফটোগ্রাফার জানতামই না। তিনি যে এমনকি লেখেন ও সেটাও একদম অজানাই ছিল। নামের কি দারুন মর্যাদা দিয়েছেন ভদ্রলোক! একদম হঠাৎ করেই পেলাম তাঁর লেখা ভ্রমন কাহিনী “আফ্রিকায় সব্যসাচী”। ভ্রমণকাহিনী দেখলে পড়ার লোভ কি আর সামলানো যায়? গপাগপ গিলে ফেললুম।

ভ্রমন ও ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি সব্যসাচী চক্রবর্তী’র নেশা। ভারতের বিভিন্ন জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ছবি তুলে বেড়ান। হঠাৎ তাঁর কাছে চলে আসে দারুন এক সুযোগ। আফ্রিকা ভ্রমনের, তাও আবার একেবারে ফ্রি তে। তাকে স্পন্সর করবে নিকন ইন্ডিয়া লিমিটেড, অ্যাভিয়ানা ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ও এলিট ফ্যুট ওয়্যার।বিনিময়ে এই ভ্রমনের যে ভিডিও হবে সেটাতে অ্যাঙ্করিং করতে হবে তাকে। আর কি চাই। গাট্টি বস্তা নিয়ে ছুটে চললেন আফ্রিকার পানে।

আফ্রিকা ভ্রমণে সব্যসাচী শুধু যে ছবি তুললেন আর অ্যাঙ্করিং করলেন তাই না, ফিরে এসে লিখে ফেললেন ভ্রমন কাহিনী ও। সব্যসাচীর সাবলীল লেখনিতে তাঁর আফ্রিকা ভ্রমনের খুটি নাটি ফুটে উঠেছে। অবশ্য আফ্রিকা ভ্রমন মানে পুরো আফ্রিকা ভ্রমন না, তারা গিয়েছিল শুধুমাত্র কেনিয়াতে। কোলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে নাইরোবি।

রাজধানী নাইরোবিতে রেস্ট নিয়ে পরদিন সকালে তারা ছুটে চলেন মাসাইমারার দিকে। এই মাসাইমারাতেই অবস্থিত এক মজার জায়গা রিফট ভ্যালি। প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত এই এলাকাটি বিশ্বের বৃহত্তম ফাটলের কারণে সৃষ্ট উপত্যকা। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়া হতে দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার মোজাম্বিক পর্যন্ত বিস্তৃত।

 

রিফট ভ্যালি

এই মাসাইমারাতে সব্যসাচী দেখতে পান গ্রেট ওয়াইল্ড লাইফ মাইগ্রেশন বা পরিযান। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় লক্ষ লক্ষ প্রানী কেনিয়া থেকে তানজানিয়া যায় আবার একটা নির্দিষ্ট সময় পরে কেনিয়ায় ফিরে আসে। এর মূল কারন হচ্ছে আগে যেখানে বৃষ্টি হয় সেখানে বৃষ্টিপাতের ফলে কচি ঘাস জন্মে। কেনিয়ার কচি ঘাস খেতে খেতে যখন কেনিয়ার কচি ঘাস শেষ হয়ে যায় তখন তৃণভোজী প্রানীরা তানজানিয়ায় অর্থাৎ দক্ষিনে চলে যায়। সেখানে বৃষ্টি শুরু হওয়ার কারনে কচি ঘাস জন্মে যায় ততদিনে। সেখানে জতদিন কচি ঘাস পাওয়া যায় ততদিন তারা সেখানে থাকে, কয়েক মাস এভাবে ঘাস খেয়ে তারা আবার কেনিয়াতে ফিরে আসে। কেনিয়া ও তানজানিয়া বর্ডার এর মারা নদী পার হয়ে এরা এই মাইগ্রেশন করে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আমি পড়তে পড়তে ইউটিউবে ভিডিও দেখছিলাম। লেখকের বর্ণনা তারপর ভিডিও, দারুন লাগছিল।

ওয়াইল্ড লাইফ মাইগ্রেশন

এরপর লেখকরা চলে যান আদিবাসী মাসাইদের গ্রামে। সেখানে মাসাইরা কিভাবে জীবন যাপন করে, তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী মাসাই নাচ দ্যাখেন তারা। এখান থেকে ফিরে পরদিন লেখকরা যান লেক নাইভাসা তে। লেক নাইভাসা তে বোটে করে ঘুরতে ঘুরতে পেলিক্যানের ঝাক, হিপোপটেমাস বা জলহস্তী, কেপ বাফেলো ও নানারকমের পাখি দেখতে পান। বলা হয় আফ্রিকায় যারা জলের ধারে বাস করে তারা যতটা না কুমীরের কারনে মারা যায় তাঁর থেকে বেশি মারা যায় হিপোর কামরে। যদিও হিপোরা মাংসাশী না, একেবারেই তৃণভোজী, কিন্তু তারা মানুষ দেখলেই আক্রমন করে। তারা স্বভাবতই আক্রমণাত্মক।

মাসাই আদিবাসী

 

লেক নাইভাসা থেকে পরদিন লেখকরা ছুটে চলেন লেক নাকুরুর পথে। নয়নাভিরাম লেক নাকুরুতে লেখকরা চাক্ষুস দেখতে পান হায়েনার পাখি শিকার। লেক নাকুরুর পাট চুকিয়ে তারা চলে আসেন অ্যাবডেয়ার ন্যাশনাল পার্কে। এই অ্যাবডেয়ার ন্যাশনাল পার্কে একটা ট্রি টপ হোটেল আছে যেটার বর্তমান অবস্থান যদিও আর গাছের উপর নেই, কনক্রিটের পিলারের উপরে, তবে পূর্বে এটি ছিল বিশাল একটি ফিগ ট্রির উপরে। সেসময় এই ট্রি টপ হোটেলে একরাত ছিলেন ব্রিটেনের তৎকালীন প্রিন্সেস এলিজাবেথ ও তাঁর স্বামী ফিলিপ। তখন ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজা। গাছবাড়ির তখন মালিক ছিল মেজর শেরব্রুক ওয়াকার। তাঁর আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে রাতে গাছ বাড়িতে থাকেন প্রিন্সেস ও তাঁর স্বামী। কিন্তু পরদিন সকালেই রাজা জর্জ মারা যান এবং প্রিন্সেস এলিজাবেথ এ রানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

 

লেক নাকুরু

একি হোটেলে পরে একসময় রাত কাটিয়েছিলেন বিখ্যাত শিকারি ও লেখক জিম করবেট। তিনি হোটেলের লগ বুকে লিখেছিলেন- “For the first time in the history of the world, a young girl climbed onto a tree one day as a princes after having what she described her most thrilling experience and she climbed down from the tree next day as a Qyeen- God bless her”.

 

অ্যাবডেয়ার এর ট্রি টপ হোটেল

অ্যাবডেয়ার এর ট্রি টপ হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন তারা ছুটে চলেন লেক অ্যাম্বোসেলির দিকে। এটি মূলত সিজনাল লেক। বর্ষার সময় থই থই পানি থাকলেও শুকনার সিজনে একদম ধু ধু মাঠ। লেখকরা শুষ্ক মৌসুমে যাওয়ার কারনে লেক অ্যাম্বোসেলি ছিল ধুলাময় তেপান্তর। তবে এখানে লেখকরা এক সিংহীর বুনো শুয়োর শিকারের বার্থ প্রচেষ্টা দেখতে পান। এই অ্যাম্বোসেলি থেকেই মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো দেখা যায় কিন্তু আকাশে মেঘ থাকায় হতাশ হতে হয় লেখকদের। সেদিন রাতে তারা অ্যাম্বোসেলি লজে রাত কাটান।

পরদিন সকালে আকাশ মেঘমুক্ত। চোখের সামনে সেই কাঙ্ক্ষিত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো, বিভূতিভূষণের “চাঁদের পাহাড়”। এটাই ছিল তাদের ভ্রমনের শেষ দিন। তাই মন ভরে চাঁদের পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে লেখকরা ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। পেছনে ফেলে আসেন রহস্যময় সুন্দর আফ্রিকা।

 

চাঁদের পাহাড় খ্যাত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো

লেখকের সাবলীল বর্ণনা ভ্রমণকাহিনীটাকে বেশ উপভোগ্য করে তুলেছে। বইটা পড়ছিলাম আর গুগল করে লেখকের বিচরন করা প্রতিটা স্পটের ছবি দেখছিলাম আর ইউটিউবে ভিডিও দেখছিলাম। সব মিলিয়ে নিজে না গিয়েও লেখকের সাথে এক টুকরো আফ্রিকা ঘুরে এলাম যেন।

বইঃ আফ্রিকায় সব্যসাচী
লেখকঃ সব্যসাচী চক্রবর্তী
প্রকাশনিঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স লিমিটেড
প্রথম প্রকাশঃ কোলকাতা বইমেলা, ২০১২
পৃষ্ঠাঃ ৮৯
মুল্যঃ ১০০ রুপি (মুদ্রিত)