দ্বিতীয় অধ্যায়।

বিছানায় কাতরাচ্ছে রাহেলা। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। পানি পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু উঠে বসে পানি খাওয়ার শক্তি তার নেই। বছর দুয়েক হল সে শক্তি রাহেলা হারিয়ে ফেলেছে। দু’বছর আগে স্ট্রোক করে রাহেলার শরীরের বামপাশটা একেবারেই প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তারপর থেকে একেবারেই বিছানায় রাহেলা। কাজের মেয়ে কুলসুম তার দেখাশোনা করে। আজ কুলসুম এখনও আসে নি। এমনটা কখনো হয় না। এ দুনিয়ায় কুলসুম ছাড়া তো আর কেও রাহেলার বিন্দু মাত্র যত্ন করার মতো নেই। একমাত্র ছেলে রাতুল নেশার অন্ধকারে ডুবে থাকে। মাকে দেখার সময় বা আবেগ কোণটাই রাতুলের নেই।

অথচ কি প্রতাপশালী মহিলাই না রাহেলা ছিল। তার ভয়ে কতো মানুষ কাঁপতো। কাস্টম অফিসার রাহেলার পাশে মানুষের অভাব তো কখনো ছিল না। তার আদেশ দিতে যতটা দেরি হতো কাজ হতে বিন্দুমাত্র দেরি হতো না। টাকার অভাব ছিল না। তবে টাকা রাখার জায়গার মাঝে মাঝে অভাব হতো। রাতুলের জন্মের পড়ে রাতুলের বাবা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি কখনো। পড়ে রাহেলা জানতে পেরেছিল রাতুলের বাবা পাড়ি জমিয়েছিল বিদেশে তার অন্য এক প্রেমিকাকে নিয়ে। সেসময় প্রচণ্ড অভাবে পরেছিল রাহেলা। রাতুলের জন্য খাবার জোগাড় করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। অভাব জিনিসটা কি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল রাহেলা। জীবনের যুদ্ধ কাকে বলে বুঝতে পেরেছিল রাহেলা। শিক্ষিত ছিল, একটা চাকরি জোগাড় করে ফেলে কাস্টম অফিসে। কাজের দক্ষতায় ধীরে ধীরে হয়ে যায় কাস্টম অফিসার। তখন চারিদিকে কেবল টাকার ছড়াছড়ি। দুহাতে কামিয়েছে সেসময়। একসময় নেশা হয়ে যায় টাকা। টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে রাহেলা নিজের সন্তান এর দিকে তাকানোর সময় পেত না। সে ভাবতে শুরু করে অর্থই জীবনের সব। রাতুলের কখনো মায়ের কাছে টাকা চেতে হয়নি। না চাইতেই কাড়ি কাড়ি টাকা পেয়েছিল রাতুল। রাহেলা মনে করেছিল টাকা দিয়ে সে তার সন্তান কে সব সুখ কিনে দিবে।

বন্ধুদের নিয়ে টাকা উড়াতে উড়াতে রাতুল একসময় হারিয়ে গেলো নেশার রাজ্যে। সারাদিন নেশায় ডুবে থাকতে থাকতে স্বাভাবিক আবেগ হারিয়ে ফেললো রাতুল। রাহেলা যখন জানতে পারলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। টনক নড়ল রাহেলার। টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিলো রাতুলকে। এতে ঘটলো উল্টো। রাতুল বাড়িতে ভাংচুর করতে শুরু করলো। রাতুল যা ভাঙ্গে রাহেলা আবার কেনে কিন্তু রাতুলকে টাকা দেয় না। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকার পর রাতুল বাড়ির জিনিস পত্র চুড়ি করা শুরু করলো। চুড়ি করে বেঁচে নেশার টাকা জোগাড় করতো রাতুল। এভাবে রাহেলার বাড়ি থেকে জিনিসপত্র কমতে থাকে। আবারও টনক নড়ে রাহেলার। সেও জিনিসপত্র কেনা বন্ধ করে দেয়। রাতুল যখন আর চুরি করার মতো কিছু না পাওয়া শুরু করে তখন শুরু হয় নতুন বিপদ। কয়েকদিন পরেই আশপাশ থেকে রাতুলের নামে অভিযোগ আসতে শুরু করলো। আজ এর বাসায় তো কাল ওর বাসায় চুড়ি করেছে রাতুল। অতিষ্ট হয়ে উঠলো রাহেলা। এক পর্যায়ে না পেরে রাহেলা পুলিশে সমর্পণ করলো রাতুলকে। কিন্তু নিজের সন্তান। নিজেকে কোনভাবেই ধরে রাখতে পারলো না। ছাড়িয়েও নিয়ে এলো। অনেক চেষ্টা করলো বুঝিয়ে ছেলে কে অন্ধকার জগৎ থেকে বের করে আনতে। কিন্তু পারলো না। সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই রাতুলকে ছিনতাই করার সময় হাতে নাতে ধরে ফেললো পুলিশ। খবর পেয়ে মাথাটা ঘুরে উঠলো রাহেলার। পড়ে গেলো রাহেলা। কাজের মেয়েটা আশপাশ থেকে মানুষ ডেকে হাস্পাতালে নিয়ে যায় রাহেলাকে। সেদিন ই রাহেলার শরীর এর বাম পাশটা প্যারালাইজড হয়ে যায় স্ট্রোক এর কারনে। তারপর থেকে রাহেলা বিছানায়।

কিন্তু কুলসুম এখনো আসছে না কেন? রাহেলার খুব অস্বস্তি লাগছে। কেমন যেন তার চারপাশটা ফাকা হয়ে যাচ্ছে। কয়টা বাজতে পারে এখন? রাহেলা বুঝতে পারছে না। ওয়ালে যে ঘড়িটা ছিল সেটা কবেই বেঁচে দিয়েছে রাতুল। ঘরে আসবাব বলতে এক রাহেলার খাটটা ছিল। আজ সেটাও নেই। সকালেই সেটা বেঁচে দিয়েছে রাতুল। তিন চারজন লোক নিয়ে এসেছিলো সকালে। তারা সবাই মিলে ধরে তোশক সহ নামিয়ে এককোণে রেখে দিয়েছে রাহেলা কে। রাহেলা অবাক হয়ে দেখেছে। খাট খুলে নিয়ে গেলো। রাহেলা এখন কাঁদলেও চোখ দিয়ে পাড়ি বের হয় না। এই দুটো বছর বিছানায় পড়ে থেকে একটু একটু করে রাহেলা তার ভুল গুলো বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আর কিছুই বাকি নেই। এমনকি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার মতো শারীরিক শক্তি ও নেই রাহেলার। তাই নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে। একটু পানি খেতে খুব ইচ্ছে করছে রাহেলার। সে বুঝতে পারছে তার সময় শেষ হয়ে এসেছে। শেষ সময়ে তার মুখে কি কেও একটু পানি তুলে দিবে না?

রাহেলা রাতুলকে ডাকার চেষ্টা করলো কয়েকবার। কিন্তু গলা থেকে কেন যেন আওয়াজ বের হচ্ছে না। গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ স্পষ্ট কানে আসছে রাহেলার। কিন্তু রাহেলার গলা শুকিয়ে মরুভুমি হয়ে আছে। একটা ফোটা পানির জন্য আগে কখনো এতো আকাঙ্খা রাহেলা অনুভব করেনি। প্রতিটা বৃষ্টি ফোটার শব্দ রাহেলাকে যেন তিরস্কার করছে।দরজা খোলার শব্দ পেল রাহেলা। মনে হয় কুলসুম এসেছে। সেই ছোট্ট বেলায় কুলসুমকে নিয়ে এসেছিলো রাহেলা। তখনো রাতুল জন্ম হয় নি। তখন থেকেই রাহেলার সাথে ছিল কুলসুম। পড়ে রাহেলা যখন চাকরিতে ঢুকলো তখন রাতুল কে এই কুলসুমই বড় করেছে। পড়ে রাহেলাই কুলসুম এর বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপর থেকে কুলসুম প্রতিদিন এসে রাহেলার বাসায় কাজ করে যায়। এমন কোনদিন হয় নি যে কুলসুম আসেনি। এই একটা মানুষ আছে পৃথিবীতে যে রাহেলাকে কখনো একা ফেলে যায় নি। সবসময় খেয়াল রেখেছে।

হ্যাঁ কুলসুম এসেছে। ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে রাহেলাকে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে গেলো কুলসুম। এক মুহূর্ত ঠায় দাড়িয়ে থেকে কুলসুম রাহেলার কাছে ছুটে গেল।

“আম্মা আপনি এখানে কেন?”
“পানি- একটু পানি খাওয়া কুলসুম”- অনেক কষ্টে উচ্চারন করতে পারলো রাহেলা।
কুলসুম ছুটে পানি নিয়ে এলো। চামচ ও নিয়ে এলো একটা।
“আম্মা হা করেন”।

হা করলো না রাহেলা। কুলসুম দেখল রাহেলা তারদিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। চোখে কোন এক বোবা কষ্ট। চোখের কোনে একবিন্দু জল। শুধু গলাটাই মরুভুমি হয়ে থাকলো।

বি.দ্রঃ সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে।