সমতলের মানুষের কাছে পাহাড় এক দুর্দান্ত বিস্ময়। আমরা দক্ষিন বাংলার মানুষ। দিগন্ত বিস্তৃত ঘের দেখে অভ্যস্ত। ঘের অনেকটা প্রবন্ধের মতো, রসকষ ঠিক থাকে না। লেক হচ্ছে কবিতার মতো। আর যদি সে লেক হয় পাহাড় দিয়ে ঘেরা তবে জীবনানন্দের কবিতার মতো কালোত্তীর্ণ হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। কাপ্তাই লেককে আমার জল পাহাড়ের কাব্য ছাড়া আর কি বলার আছে।
গত সেপ্টেম্বরে গিয়েছিলাম বন্ধুর বিয়েতে চট্টগ্রাম। পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রাম যাবো অথছ পাহাড়ের কোলে ছুটে যাবো না তা কি হয়? বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ করে আমি আর আমার চিত্রকর বন্ধু আজম ছুটে গেলাম রাঙামাটির পানে। উদ্দেশ্য কাপ্তাই লেক। বন্ধু ছবি আকবে, আমি দুচোখ মেলে জল পাহাড়ের কাব্য দেখবো।
কাপ্তাই লেকের গা ঘেসেই হোটেল। জানালা দিয়ে তাকালেই পাহাড় দিয়ে ঘেরা লেক। পৌছাতে পৌছাতে রাত হয়ে গিয়েছিল। অপেক্ষা কখন ভোর হবে, সূর্যোদয়ের কাপ্তাই লেক দেখবো। খুব ভোরে যখন চুপ করে সূর্যি মামা উকি মারতে শুরু করলো পাহাড়ের পেছন থেকে, ঝুল বারান্দায় আমি বিহ্বল তাকিয়ে আছি। অপার্থিব। যেন তুলিতে রঙ মাখিয়ে কেউ দিগন্তে রঙ ছরাচ্ছে।
ন’টার দিকে নাশতা করে বেড়িয়ে পড়লাম। বন্ধু আজমের পরিচিত আরেক চিত্রকর দিব্য আলো চাকমা, যার আমন্ত্রনে মূলত রাঙ্গামাটি যাওয়া, মোটরসাইকেল ট্যুর এ নিয়ে চললো আমাদের। লেকের পাড় ধরে পাহাড়ি পথে ছুটে চললাম অনেকটা পথ। গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে হচ্ছিলো “একি লাবন্যে পূর্ণ প্রান”।
সারাদিন ঘোরাঘুরি হল। দুপুরে পেট ভরে খেলাম “গাং সাবারাং” এ। দারুন লোকেশান আর ইন্টেরিওর এর কারনে গাং সাবারাং এর কথা মনে থাকবে দীর্ঘদিন। খাওয়াদাওয়া শেষে আবার ঘোরাঘুরি পাহাড়ের কোলে। পাহাড়ের বুকে সূর্য যখন ঘুমাতে চলে গেল তখন ফিরলাম হোটেল এ। ফ্রেস হয়ে আবার বেড়িয়ে পড়লাম। এবার রাতের লেক দেখতে হবে ভেসে ভেসে।
একটা ট্রলার ভাড়া করে ভেসে পড়লাম লেকের জলে। সাথে দিব্য আলোর কয়েকটা বন্ধু। আড্ডা আর রাতের কাপ্তাই এর সৌন্দর্য দর্শন চললো সমান্তরাল গতিতে। রাতের কাপ্তাই, আহা, বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। মনে হচ্ছিল চিরকাল যদি এভাবে ভেসে বেড়াতে পারতাম। যাই হোক, ঘন্টা দুয়েক পরে ফিরে এলাম। রাতের খাওয়া সেরে ঘুম, সকালে আবার সূর্যোদয় দেখতে হবে।
পরদিন খুব ভোরে আবার উঠে বারান্দায় চলে এলাম। সূর্য মামা তখন কেবল উঁকি মাড়তে শুরু করেছে। আকাশ জুড়ে রঙ এর খেলা। প্রতি মুহূর্তে রুপ পরিবর্তন করছে। তবে একটু বেলা বাড়তেই অবশ্য সেই চিরচেনা কাটখোট্টা সূর্য। ভোরের সূর্য যেন বিয়ের সাজে কনে।
নাস্তা সেরে রিজার্ভ করে রাখা ট্রলারে করে ভেসে পড়লাম লেকের জলে, শুভলঙের দিকে। ঠিক হল কোন একটা সুন্দর জায়গা দেখে দাড়িয়ে পড়বো, আজম ও দিব্য আলো ছবি আকবে, আমি ঢেউ টিন। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন “তোমার ভাজ খোলো আনন্দ দেখাও”, কাপ্তাই ও ঠিক তেমন, একটু একটু সামনে আগাচ্ছি আর যেন রুপ লাবন্য বেড়েই যাচ্ছে। দু’পাশে সবুজ পাহাড়, দিগন্তে নীল পাহাড়, লেকের জলে আলো-ছায়ার খেলা আর কি চাই? শুভলঙের কিছুটা আগে একটা ঝর্নার পাশে ট্রলার ভেড়ানো হল। আজম আর দিব্য ছবি আঁকতে বসে গেল, আমি ছুটে গেলাম ঝর্নার পানে। একা একা বসে আছি ঝর্নার জলে পা ভিজিয়ে। অনুভূতি কি সবসময় ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যায়?
ছবি আঁকা শেষ করে আজম আর দিব্য এলে ঝর্নার শীতল জলে গোসল করে নিলাম, তপ্ত দুপুরে শীতল জল, আহা। গোসল সেরে চলে গেলাম শুভলঙ। দুপুর তখন দু’টোর মতো বাজে। পেট ভরে খেয়ে নিলাম একটা হোটেলে। তারপর ফিরে চললাম সমতা ঘাটের দিকে। আবারো দুপাশে, সামনে, পেছনে শুধুই প্রকৃতির অপরুপ রুপ।
বিকেল থাকতে থাকতেই ফিরে এলাম সমতা ঘাটে। রাতে বাস। হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ব্যাগ গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। গরবা নামে দারুন একটা রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে গিয়ে লেমনেড খেলাম। রুফ টপে বসেছিলাম। এমন সময় টুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। আকাশ জুরে আবারো অপার্থিব রঙ এর খেলা শুরু হয়ে গেলো।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরে চললাম আবার কাঠখোট্টা নগরে, কংক্রিটের জঞ্জালে। পেছনে পড়ে থাকলো জল ও পাহাড়ের কাব্য। হৃদয়ের খেরখাতার দুটো পৃষ্ঠা শুধু আলতো তুলির টানে রঙিন হয়ে থাকলো। কে যেন বলেছিল, জীবনে বেঁচে থাকাটাই সুখের। বেঁচে আছি বলেই প্রতি মুহূর্তে বিস্মিত হচ্ছি।
বি.দ্রঃ প্রতিটা ছবিই আমার নিজের তোলা।