চড়ুই পাখিটা একা একা বারান্দার রেলিঙ এ বসে আছে। বেশ নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে তাকে। এ সময় তার এভাবে বসে থাকার কথা না। পড়ন্ত বিকেল। আর একটু পরই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যাবে। এ সময় তার খাবার খোজার কথা। সামনে দীর্ঘ একটা রাত। কিন্তু খাবার না খুজে একা একা বসে আছে। মোনা অনেকক্ষণ যাবৎ পাখিটাকে লক্ষ্য করছে। এ সময়টাতে মোনা প্রায় প্রতিদিন এক মগ কফি নিয়ে বারান্দায় বসে থাকে। কফির মগে আলতো করে চুমুক দিতে দিতে দেখতে থাকে কিভাবে বিকেলের আকাশটা লাল হতে হতে ঝুপ করে হঠাৎ আধারে ঢেকে যায়। আজ ও ব্যাতিক্রম হয়নি। মোনা তার খুব প্রিয় বারান্দায় বসে আছে। পশ্চিম আকাশটা লাল রং ধারন করেছে। মোনা চুমুক দিচ্ছে কফির মগে। পাশের বাড়ির ছেলেটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে ছাদে। প্রতিদিন এ সময় ছেলেটা ঘুড়ি নামিয়ে ফেলে। কিন্তু আজ সে ও কেন জানি ঘুড়ি নামাচ্ছে না। আজ তার ও মনে হয় মোনার মতো মন খারাপ। মন খারাপ রোগটা বেশ ছোঁয়াচে ধরনের। মোনার কেন যেন মনে হচ্ছে তার মন খারাপ বলেই চড়ুই পাখিটা বিমর্ষ হয়ে খাবার না খুজে তার পাশে বসে আছে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। পাশের ছাদের ছেলেটাও মনে হয় মোনার মন খারাপ বুঝতে পেরেই এখনো ঘুড়ি ওড়াচ্ছে তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। হঠাৎ করেই মোনার মন ভালো হতে থাকে।
মোনা এমনি। বেশিক্ষন মন খারাপ করে থাকতে পারে না। খুব ছোট ছোট কারনে তার মন ভালো হয়ে যায়। এই তো সেদিন ক্লাসে একটু দেরি করে যাওয়ায় সুব্রত স্যার তাকে কি বকাটাই না দিলো। অথচ মোনা কখনোই দেরি করে ক্লাসে আসে না। মোনার খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। থেকে থেকে কান্না আসছিল। কোনরকমে মাথা নিচু করে ক্লাস করেছিল সে। ক্লাস শেষে মোটামুটি ছুটে বেরিয়ে গেলো। রিক্সা নিয়ে সোজা বাড়ির পথে রওনা দিলো। পথে দু’টো টোকাই শিশুকে একটা আইস্ক্রিম ভাগ করে খেতে দেখে তার মন ভালো হয়ে যায়। একটা আইস্ক্রিম দু’জন মিলে খাচ্ছে তারপর ও কি তৃপ্তি তাদের মুখে। মোনা রিক্সা থামিয়ে পাশের দোকানে ঢুকে চারটা আইস্ক্রিম কিনে ফেললো। বাচ্চা দু’টোকে ডেকে তাদের হাতে দু’টো ধরিয়ে দিলো, রিক্সাওয়ালাকে একটা দিলো। আরেকটা নিজে খেতে শুরু করলো। বাচ্চাদুটো আর রিক্সাওয়ালা একটু একটু করে আইস্ক্রিম খায় আর মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অবাক বিস্ময় তাদের চোখে। মোনা দেখেও না দেখার ভান করে। সারাটা দিন অদ্ভুত এক ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে মোনাকে।
কিন্তু আজতো এতো সহজে মন ভালো হওয়ার না। তবুও কেন যেন মোনার মন ভালো হতে থাকে। চড়ুই পাখিটাকে তার খুব ভালো লাগতে থাকে। ভালো লাগতে থাকে পাশের ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো ছেলেটাকে। আকাশ জুড়ে শেষ বিকেলের রঙ এর খেলা ভালো লাগতে থাকে। কিন্তু সাথে সাথেই মন খারাপ ভাবটা ও ফিরে ফিরে আসতে থাকে। গতকাল থেকেই স্বচ্ছ’র মুঠোফোনে কল করার চেষ্টা করছে মোনা। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। এমনটা কখনোই হওয়ার কথা না। কাল বিকেলে স্বচ্ছ’র দেখা করতে আসার কথা ছিল। মোনা কিছুদিন আগে স্বচ্ছ কে একটা গেরুয়া রং এর পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছিল। স্বচ্ছ বলেছিল ওই পাঞ্জাবিটা পড়ে আসবে। স্বচ্ছ খুব সময় মেনে চলা ছেলে। মোনার ঠিক সময় মেনে চলা হয় না। তার কখন কি যে ভালো লেগে যায় ঠিক নেই। আর কিছু ভালো লেগে গেলে সময়ের বারোটা বেজে যায়। তার মাথায় তখন আর কিছু থাকে না। স্বচ্ছ প্রায় মোনাকে রাগ করতো। মোনার হয়তো দেখা করার কথা এগারোটায় মোনা এলো বারোটায়। রাস্তায় হয়তো একটা ছোট্ট মেয়েকে ফুল বেচতে দেখে তার খুব মায়া হয়েছিল তাই তাকে ফুল বেচায় সহযোগিতা করছিল। কিন্তু কাল মোনা ঠিক সময় মতো উপস্থিত ছিল কিন্তু স্বচ্ছ আসেনি। এমনটা কখনো হয় নি। স্বচ্ছ’র মুঠোফোনটাও বন্ধ। মোনা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে চলে এসেছিলো। তার খুব রাগ হচ্ছিলো। আবার ভয় ও হচ্ছিলো। খারাপ কিছু হল না তো আবার। সেই থেকে মোনা চেষ্টা করে যাচ্ছে স্বচ্ছকে কল করার। কিন্তু পাচ্ছে না। আজ সকালে স্বচ্ছ যে মেসে থাকে সেখানেও গিয়েছিলো। কিন্তু স্বচ্ছ নেই। পাশের রুমের ছেলেটা বলল স্বচ্ছ নাকি কাল রাতেও ফেরেনি। মোনার খুব ভয় হতে থাকে। সে ছেলেটাকে তার নাম্বার দিয়ে বলে আসে কোনও খোজ পেলে যেন তাকে জানায়।
মোনার আবার কান্না পেতে থাকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। মনে পড়তে থাকে স্বচ্ছর সাথে প্রথম পরিচয় এর দিনের কথা। ক্লাস করে ভার্সিটি থেকে ফিরছিল মোনা। বেশ বৃষ্টি হচ্ছিলো। হঠাৎ মোনা দেখলো ফুটপাথের উপর একটা ছেলে ছাতা দিয়ে ঢেকে একটা বিড়ালের ছোট্ট বাচ্চাকে কি যেন খাওয়াচ্ছে। নিজে ভিজে যাচ্ছে সেদিকে যেন কোনও হুস নেই। মোনার খুব ভালো লেগে গেলো। সে রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়লো। কাছে গিয়ে দেখে একটা চিপস এর খালি প্যাকেট এ করে চা খাওয়াচ্ছে ছেলেটা বিড়ালছানাটাকে। মোনা পাশে বসে পড়লো।
“আমি একটু আদর করতে পারি আপনার বিড়ালের বাচ্চাটাকে?”
“বাচ্চাটা আমার না। এখানে বসে ভিজছিল। এতোটুকুন বাচ্চা। ঠাণ্ডায় মারা যাবে। তাই ছাতি দিয়ে একটু ঢেকে গরম চা খাওয়াচ্ছি। আপনি কি একটু ছাতাটা ধরবেন তাহলে আমি ওর জন্য একটা বিস্কিট নিয়ে আসি”।
“অবশ্যই, আমি আছি। আপনি নিয়ে আসেন”।
ছেলেটা ছুটে চলে গেলো পাশের চা এর দোকানে। মোনা মগ্ন হয়ে আদর করতে থাকলো বিড়াল ছানাটাকে। সে এর মধ্যে ছানাটাকে একটা নাম ও দিয়ে ফেলেছে। পিউ। ছেলেটা ফিরে এলো দু’কাপ চা আর একটা বিস্কিট হাতে নিয়ে।
“বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কখনো চা খেয়েছেন এর আগে?”
“জি না। কখনো খাওয়া হয় নি”।
“এই নিন। আজ খেয়ে দেখুন”।
“থাঙ্কস”।
“ওহ, আমি স্বচ্ছ”।
“আমি মোনা। পিউ খুব কিউট তাই না?”
“পিউ?”
“আপনাকে তো বলাই হয়নি। আমি ছানাটার নাম রেখেছি পিউ। আপনি মাইন্ড করেননি তো?”
“আরে নাহ মাইন্ড করবো কেন। অনেক সুন্দর নাম দিয়েছেন। নেন বিস্কিটটা আপনিই খাওয়ান। চা এ ভিজিয়ে দিয়েন। বাচ্চাতো”।
মোনা মহা আনন্দে পিউ কে চা এ ভিজিয়ে বিস্কিট খাওয়াতে থাকে। নিজেও চা এ চুমুক দিতে থাকে। তার খুব ভালো লাগতে থাকে। মোনার কোনও কিছু খুব ভালো লাগলে চোখ ভিজে যায়। ভাগ্যিস বৃষ্টি হচ্ছিলো। নাহলে স্বচ্ছ মোনার চোখের জল দেখে ফেলতো।
সেই থেকে স্বচ্ছকে চেনে মোনা। কিন্তু কখনোই এমন হয় নি। মোনা হঠাৎ তাকিয়ে দ্যাখে পাশের ছাদের ছেলেটার ঘুড়ির সুতো ছিঁড়ে গেছে। ঘুড়িটা একা একা উড়ে যাচ্ছে। মোনার মুঠোফোন বেজে উঠলো। শব্দ শুনে চড়ুইটাও উড়ে গেলো। ফোন করেছে স্বচ্ছর পাশের রুমের ছেলেটা। মোনা তাড়াহুড়ো করে ফোনটা ধরলো।
“হ্যালো। স্বচ্ছর কোনো খোজ পেলেন?”
“ইয়ে, মানে। কিভাবে যে বলি আপনাকে!”
“কি হয়েছে বলুন?”- মোনার গলা কেঁপে উঠলো।
“স্বচ্ছ আর নেই। কাল বিকেলে অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। স্পট ডেড। মেডিকেলের মর্গ এ লাশ সনাক্ত করেছি আমরা একটু আগে”।
মোনার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল সুতো ছেড়া ঘুড়িটা দিগন্তে হাড়িয়ে গেছে। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে। রেলিঙ এ বসা চড়ুই পাখিটাও নেই। মোনা একা হয়ে গেলো। একদম একা। ঝাপসা চোখে মোনা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। পায়ের কাছে পড়ে থাকা মুঠোফোন থেকে হালকা আওয়াজ আসছে- “হ্যালো, হ্যালো”।