“সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা” বদরুদ্দীন উমর এর প্রবন্ধ সংকলন। কিভাবে আমাদের এই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা সংস্কৃতিকে পেঁচিয়ে ধরেছে সেটা দারুন ভাবে লেখক চোখের সামনে নিয়ে এসেছেন। সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন “তত্ত্বগতভাবে সংস্কৃতিকে ধর্মের অন্তর্গত মনে করাকেই সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার মুলসুত্র বলে ধরা যেতে পারে”। অর্থাৎ সোজা কথায় যখনি আপনি বাঙালি সংস্কৃতিকে টুপি পাঞ্জাবি অথবা ধুতি পৈতে পড়িয়ে ফেলবেন তখনি সেটা হয়ে উঠবে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা।
পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৯৪৭ সালে বাংলা হরফ পরিবর্তনের দাবী তোলেন। তিনি বাংলা ভাষা থেকে বাংলা হরফ বাদ দিয়ে আরবি হরফকে সে স্থলাভিষিক্ত করার প্রস্তাব করেন।
এ ব্যাপারে তার প্রধান যুক্তি ছিল যে, বাংলা অক্ষর পুরোপুরি দেবনাগরী থেকে সৃষ্টি, কাজেই সে হরফ হিন্দুর। হিন্দু হরফ দিয়ে কোন মুসলমানী ভাষা সম্ভব নয়, কাজেই বাংলা ভাষার ধর্মান্তরের জন্য তার হরফের ধর্ম পরিবর্তন প্রয়োজন। ভাষার কি কোন ধর্ম থাকে?
লেখক বলেছেন- “মাত্র কিছুসংখ্যক ব্যাতিত বাংলায় সমস্ত মুসলমানেরই পূর্বপুরুষরা এদেশের অধিবাসী এবং হিন্দু। কাজেই ধর্মীয় কারন ব্যাতিত অন্য কোন কারনে বাংলাদেশকে পুরোপুরি স্বদেশ মনে না করার কোন কারন তাদের ছিল না। কিন্তু উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা নিজেদের সুবিধামত এক জাতিতত্ত্ব আবিস্কার করে ক্রমাগত প্রচার করলো যে, সৎবংশজাত মুসলমান মাত্রেরই পূর্বপুরুষ আরব, ইরান, তুর্কি থেকে আগত। এর ফলে মুসলমানেরা নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নতি হওয়া মাত্র সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যা বংশতালিকা রচনা করে সচেষ্ট হলেন নিজেদের বংশ পরিচয় পরিবর্তনের। এভাবেই মুসলমানেরা আত্মিক দিক থেকে স্বদেশে থাকলেন পরবাসী হয়ে”।
অবশ্য পরবর্তীতে এ মোহ কেটেছে অনেকটাই। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৪৭ থেকে ৫২ পর্যন্ত ভাষার জন্য লড়াই করতে করতে মুসলমান বাঙলী ধিরে ধিরে বাঙালী মুসলমানে পরিনত হতে থাকে। তবে এ অবস্থা অবশ্য এখনো প্রখর বাংলাদেশের বিহারী সম্প্রদায়ের ভেতর রয়ে গেছে। তারা মুসলমান হওয়ার প্রবল চেষ্টায় বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি এখনো।
একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালেই আমরা দেখতে পাই ১৮৩১ সালে বাংলা ভাষায় প্রথম মুসলমান পরিচালিত সাময়িকি পত্র প্রকাশিত হয়। নাম রাখা হয় “সমাচার সভারাজেন্দ্র”। নাম শুনে বেশ অবাক হচ্ছেন? আপনি যেমনটা আশা করছেন তেমন নাম এসেছে পরে, ধীরে ধীরে, লহরী, সুধাকর এমন আরবি ফারসি নামে সাময়িকি পত্র ছাপানোর চিন্তা তখনো এসে পারেনি।
ভাষা মানুষের জীবনের প্রধান ঐক্যসুত্র। আর এ কারনেই নির্দিষ্ট কিছু মানুষ হয়তো চেয়েছিল বাঙালির এই ঐক্যসুত্রে চির ধরাতে। একারনে একসময় বাংলায় ভাষার ধর্মীয়করন খুব তোর জোরের সাথে শুরু হয়। পারলে ভাষাকে চেপে ধরে খাৎনা দিয়ে দেওয়া হত।
বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা উপাধি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্থান চেয়েছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য বিলীন করার জোর প্রচেষ্টা তারা নিয়েছিল।
এ নিদর্শন যে শুধু বাংলাদেশ ভারত পাকিস্থান বা এই উপমহাদেশেই ঘটেছে তা কিন্তু না। এমন চেষ্টা যুগে যুগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে করা হয়েছে। উদাহরন স্বরূপ বলা যায় ল্যাটিন ভাষার কথা। রোমান সম্রাজ্যের প্রতাপের পর থেকে আধুনিক যুগের উত্থানের সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ল্যাটিন ভাষা ছিল প্রচলিত। এর মূল কারন ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব। ইউরোপে খ্রিস্টান চার্চ বিভক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রোমের নেতৃত্বে রোমান ক্যাথলিক চার্চই ইউরোপের সর্বত্র রাজত্ব করতো।
এসময় দেখা যেত ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন ইত্যাদি দেশের নিজ নিজ ভাষা থাকা সত্ত্বেও সেসব দেশের উচ্চবিত্তরা সেসব ভাষায় কথা না বলে ল্যাটিন ভাষায় কথা বলত। এমনকি সম্ভ্রান্ত লেখকরা পর্যন্ত নিজ মাতৃভাষায় না লিখে ল্যাতিন এ লিখত। খোদ ইংল্যান্ড এর কথাই ধরুন, ফ্রান্সিস বেকনের পূর্বে কোন সম্ভ্রান্ত ইংরেজ লেখক ইংরেজিতে লেখেনি, লিখেছে ল্যাতিন এ। এমনকি বেকন পর্যন্ত তার প্রধান দার্শনিক গ্রন্থ লিখেছিলেন ল্যাতিনে।
রেনেসাঁস রিফরমেশন, শিল্প বিপ্লবের পরে ইউরোপে যে নতুন জাতীয়তাবোধের জাগরন ঘটলো তখন ধীরে ধীরে ল্যাতিন এর প্রভাব এসব দেশ থেকে হারাতে শুরু করলো। মাতৃভাষা ফিরে পেল তার স্থান।
তো বুঝতেই পারছেন সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা সংস্কৃতিকে কতটা জাপটে ধরে। সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলে তখন তার স্বকীয় প্রবাহ। বদরুদ্দীন উমর এর সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা পড়লে এ ব্যাপারে আরো ধারনা পাবেন। তাই পড়ে ফেলুন, জানুন, বুঝুন।
বইঃ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা
লেখকঃ বদরুদ্দীন উমর
প্রকাশনিঃ শ্রাবন প্রকাশনি
পৃষ্ঠাঃ ১০১
মুল্যঃ ১১০/- (মুদ্রিত)